ধর্মীয় মূল্যবোধই পারে আত্মহত্যা বন্ধ করতে

শরিফ হাসান খান

নেত্রকোণা সরকারি কলেজ ।প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ।অনার্স চতুর্থ বর্ষ

আত্মহত্যা মহাপাপ।আত্মহত্যা কখনো কোন কিছুর সমাধান হতে পারেনা।বরং এটি পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার উদ্রেক ঘটায়।প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে যেন সমান তালে বেড়ে চলছে তরুণ তরুণীদের আত্মহত্যা। ২০১৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের আত্মহত্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ। তথ্যে জানা যায়, আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। যা ২০১১ সালে ছিল ৩৮তম। বর্তমানে আত্মহত্যার প্রবনতভয়াবহ রুপ নিচ্ছে।তরুণ তরুণীদের মধ্যে হঠাৎ কেনো বাড়ছে আত্মহত্যা? এই প্রশ্নের কি কোন উত্তর নেই? একজন মানুষ তখনই আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটায়, যখন সে কোনো কারণে হতাশ হয়, ব্যর্থ হয় কিংবা জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলে। এসবের ফলে তার মধ্যে কাজ করে বিষণ্নতা আর উদ্বিগ্নতা। কখনো কখনো জীবনের কোনো পর্যায়ে এসে কেউ মনে করে, সে আর সফল হতে পারবে না, এমনকি সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা আর তার মধ্যে নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্যদের বোঝা হওয়ার অনুভূতি জন্মে অনেক সময়। একজন তরুণ শিক্ষার্থী যে স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠে, তা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন সে হতাশ হয়। সে মনে করতে থাকে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না বা সমাজে সে ছোট মনে করতে থাকে নিজেকে। তখন সে আর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এভাবেই সে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।তরুণদের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখন অনলাইনভিত্তিক মিডিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ভিডিও বা ব্লগে আত্মহত্যার বিবরণটির সঙ্গে এই কাজটির বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায় কেউ কেউ। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজের কারণে। এভাবে কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে আত্মহত্যার প্রশংসা বা রোমান্টিসাইজ করা হয়। আবার সংবাদ মাধ্যমে বা ভিডিওতে যখন একটি নির্দিষ্ট উপায় কী করে নিজেকে হত্যা করা যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়, তখন এটির প্রবণতা বাড়তে পারে। বর্তমানে তরুণদের মধ্যে একদল টিকটক প্রতিবন্ধী নামে খ্যাত যারা টিকটকে আত্মহত্যার ভিডিও বানাতে গিয়ে নিজের গলায় ফাঁস লেগেই মৃত্যু ঘটছে। মানুষের মনমানসিকতা কতটা নিচে নামলে এই ধরনের কাজ করতে পারে শুধু লাইক আর ভিউ পাওয়ার আশায়। সামান্য সামাজিক স্ট্যাটাস আর অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার নেশায় নিজের জীবনটা বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে। আবার আত্মহত্যাকারীরা অনলাইনে নতুন এক ট্রেন্ড চালু করেছে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “বিদায় পৃথিবী বিদায় ” এমন স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সম্প্রতি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে জানা গেছে চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট বাংলাদেশে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এই প্রতিবেদনে উঠে আসে আত্মহত্যার উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি কারণ প্রেমঘটিত ব্যাপার, পড়াশোনার চাপ,পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া,সেশনজট,স্বামী পছন্দ না হওয়া, অভিমান,মোটরবাইক কিনে না দেওয়া, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মতো বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা ঘটছে।কোন ধর্মই এই আত্মহননকে সমর্থন করে না। হাদিস শরীফে আছে, নবী করিম সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করবে (যাকে আত্মহত্যা বা আত্মহনন বলে) তার শাস্তি হচ্ছে, অনন্তকাল সে এভাবেই প্রতিনিয়ত বারবার হত্যা করতে থাকবে। কয়েকটি গবেষণায় উঠে এসেছে যেখানে দেখা গেছে যারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেনা আর যারা ধর্ম পালন করে তাদের মধ্যে ধর্মহীন মানুষদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবনতা বেশি। তার মধ্যে ৩৭১ জন ডিপ্রেশনের রোগীদের মাঝে ধর্মহীন রোগীরা বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আর ৭০০ জন এডভান্সড ক্যান্সার রোগীর মাঝে গবেষণায় এসেছে, ধর্মহীন রোগীদের মাঝে আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে বেশি। ফলে সমাজের এই অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে পরিবারের অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার সাথে ধর্মীয় অনুশাসন শিখানো। পাশাপাশি অন্যদের সাথে তুলনা করার প্রবণতা থেকে অভিভাবকদের বের হয়ে আসতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ দূর করতে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। পাশাপাশি অন্যদের সাথে তুলনা করার প্রবণতা থেকে অভিভাবকদের বের হয়ে আসতে হবে।অতি উচ্চাশার ফলে অনেকসময় বাবা-মা সন্তানদের উপর মানুষিক চাপ প্রয়োগ করেন। উদাহরণ হিসাবে দাড় করান অমুকের ছেলে মেয়ে পারলে তুমি কেনো পারোনা। এমন নিচু মনমানসিকতা সমাজে অনেক মানুষের মধ্যে রয়েছে যে কারণে সন্তানরা চাপ সামলিয়ে উঠতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়।আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে আর পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সব সময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি সার্বক্ষণিক হটলাইন এখন সময়ের দাবি।আত্মহত্যা প্রবণতায় ভোগা লোকগুলো প্রথমত পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। তাই, এ অবস্থায় পরিবারকে সচেতন হতে হবে। তার প্রতি পরিবারের সাপোর্ট প্রয়োজন। সামাজিকভাবেও তাদের পাশে থাকতে হবে।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্মহত্যা বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *