শিক্ষকরা কেন রক্ষক থেকে ভক্ষক হচ্ছে?

শরিফ হাসান খান

নেত্রকোণা সরকারি কলেজ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ।অনার্স চতুর্থ বর্ষ

পিতামাতার পরে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদার আসনে যারা অধিষ্ঠিত তারা হলেন শিক্ষক।শিক্ষককে বলা হয় দক্ষ মানুষ গড়ার কারিগর। তারা আমাদের নৈতিকতা শিখান, সৎপথে, ন্যায়ের পথে চলতে শেখান।যে নৈতিকতার বীজ শিক্ষাজীবনের শুরুতে শিশুমনে একবার বপন করেন শিক্ষকেরা সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে সারাজীবন শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মজীবনে বৃক্ষের মতো ছায়া দেয়, ফুলের মতো সুবাস ছড়ায় সমাজের প্রতিটি সেক্টরে।সে সুমিষ্ট ফলের স্বাদ কখনো কখনো আস্বাদন করেন শিক্ষাগুরুরা তাদের কেউ কেউ কর্মজীবনেই আবার কখনো অবসর নেওয়ার পরেও। শিক্ষাগুরুরা তাদের সু-শিক্ষিত শিষ্যদের নিয়ে গর্ববোধও করে থাকেন কখনো কখনো।আদর্শবান,ন্যায় নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের দেখলে তাদের সম্মানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাথা নুয়ে আসে।শিক্ষার্থী যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ডাক্তার, ব্যারিস্টার কিংবা এমপি-মন্ত্রীও হয় একজন আদর্শ শিক্ষককে দেখা মাত্রই তার নিজ চেয়ারটা ছেড়ে শিক্ষকে সম্মান দেখিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। এমনটাই হওয়া উচিত।

কিন্তু বর্তমানে মুষ্টিমেয় শিক্ষকদের কারণে শিক্ষক সমাজের সেই সম্মানের জায়গাটা ক্রমশ বিতর্কিত হচ্ছে। অভিভাবকরা এখন আর এই সম্মানিত পেশার মানুষদের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না।এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েকে পড়তে পাঠিয়ে তাদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন থাকেন।বর্তমানে শিক্ষকরা যৌন হয়রানির সাথে জড়িত, প্রশ্নফাসের মতো অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে শিক্ষা নামক মহান পেশাকে কলঙ্কিত করছে! শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক থাকে মধুর।শিক্ষকদের ভোলা উচিত নয়,পিতা মাতার পর একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ,সবচাইতে বেশি ভরসার স্থান ।আর বিশ্বস্ততার এই সরলতাকে কাজে লাগিয়ে সন্তানসম ছাত্রীর সাথে এমন লজ্জাজনক আচরণ কোনো শিক্ষক কিভাবে করতে পারেন? শিক্ষকতা হচ্ছে এক মহান ও মর্যাদাকর পেশা।অথচ কতিপয় শিক্ষক এই মহান পেশার মর্যাদাকে কী অবলীলায় ভূলুণ্ঠিত করে চলেছেন।তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে ন্যায় নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের।

শিক্ষকদের সম্মান অন্য যেকোনো দশটা পেশার চাইতে বেশি।তারা সমাজের সবচেয়ে আদর্শ মানুষ, অনুসরণীয় ব্যাক্তি। একসময় কোন শিক্ষককে কেউ লাঞ্ছিত করলে ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠতো বিচারের দাবিতে প্রতিবাদে রাস্তায় নামতো।আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি আজকে তার উল্টোটা ঘটছে। শিক্ষার্থীরা সময়ের পরিক্রমায় এখন তাদের সহপাঠীদের যৌন হয়রানির, ধর্ষণের বিচারের দাবিতে স্বয়ং শিক্ষকদের শাস্তির দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছে।দেখা যায়, সবসময়ই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনা চেপে যায়।রক্ষকেরাও যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে,তখন আত্মসম্মানের কথা ভেবে বেশীরভাগ ভূক্তভোগিরা চুপ থাকেন। শিক্ষক হয়ে যখন এরকম ঘৃণ্য কাজ করেন, তখন তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। একজন শিক্ষক কেবল মেধাবী ও উচ্চ ডিগ্রিধারী হবেন না; তার নৈতিক মান ও নীতিবোধও উঁচু হওয়া উচিত। উদ্বেগের বিষয়, আমাদের শিক্ষাঙ্গনে নীতি ও নৈতিকতাবোধ বিবর্জিত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। অনেক সময় ছাত্রী কিংবা নারী শিক্ষকেরা যৌন হয়রানির শিকার হলেও মুখ বুজে সহ্য করেন। যখন কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করেন বা প্রতিকার চান, তখনই সেটি গণমাধ্যমে আসে। প্রতিকারের দাবি ওঠে।ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করা শিক্ষকদের নামের তালিকা তৈরি করতে গেলে বড় একটি কিতাব হয়ে যাবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন প্রাইমারি, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকও।

পপুলেশন কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের ৭৬ শতাংশ কিশোরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়এনজিওদের মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের পরিচালিত এডুকেশন-ওয়াচ ২০১৭ নামক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্ধেক শিক্ষক নিজেদের নৈতিক আদর্শ মনে করেন না। আরো বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ, মাধ্যমিকের দুই তৃতীয়াংশ এবং, উচ্চ শিক্ষার ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের নৈতিক আদর্শ মনে করেন না।

শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন ঘটছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাদের নৈতিকতা নিয়ে লেখতে গেলে লজ্জাবোধ হয়।বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেও কিছু অসাধু শিক্ষক একই কাজ বারবার করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।আবার কেউ কেউ প্রভাব কাটিয়ে থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।’কাকে আর বিশ্বাস করবো’? প্রশ্নটি বর্তমান শিক্ষা সচিবের। সদ্য শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষার দিনাজপুর বোর্ডের প্রশ্নফাস হয়েছে। আর এই কাজটা করেছেন একজন শিক্ষক।লোভের বশবর্তী হয়ে রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে এমন গর্হিত কাজ করা অত্যন্ত ঘৃণিত ও নিন্দনীয়। এমন কাজে পুরো শিক্ষক সমাজের আদর্শ,সততা,ন্যায়প্ররায়ণতা বারবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে।শিক্ষকরা আরো বেশি মূল্যবোধসম্পন্ন, ব্যাক্তিত্ববান হয়ে সুখী সমৃদ্ধ উন্নত দেশ গড়বেন সেই প্রত্যাশা করে জাতি। আর উন্নত জাতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার। নৈতিক শিক্ষাই পারে আলোকিত মানুষ গড়তে । আলোকিত মানুষরাই তো এক দিন গড়ে তুলবে আলোকিত দেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *