আসমাউল হুসনা তৃপ্তি
Published: 28/10/2024
হাস্যোজ্জ্বল চাহনি, সৌন্দর্য নাকি ভীতি! বুঝে ওঠার আগেই মাথায় সজোরে এক পাথরের আঘাতে নিথর হয়ে পরে রইলো নিলা! দূরে দাড়িয়ে ভীতিকর হাসিওয়ালা এক বিদ্ঘুটে চাহনি, যেন তার শেষ নিঃশ্বাসের সময় গুনছিলো! সময় রাত ১২টা, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২১!
গল্পের শুরু রংপুর জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে, ১৯৯৫ সালের ১২ই মার্চ, মা বাবার কোল আলো করে দুনিয়ায় নীলার আগমন! প্রথম কন্যা সন্তানের আগমনে মা যতোটা না খুশি, বাবা ঠিক ততটাই অখুশি! কারণ- প্রথম সন্তান মেয়ে হলে ঘর সমলাবে কে! বুড়ো বয়সে দেখবে কে! সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতকটা জানতোই না তার জীবনে কতোটা সংগ্রাম লিখে রেখেছেন উপরওয়ালা!
দিন যায় আর বাবার তার প্রতি অসন্তুষটি যেনো বাড়তেই থাকে! মেয়ের বিয়ে দেয়ার তোর জোর লেগে যায় যখন বয়স সবে ১৩! নীলার বয়স ১৩ হতে হতে অবশ্য নীলার মায়ের আরও তিন কন্যা সন্তান হয়েছে, যার ফলস্বরূপ বাবার মনে দ্বিতীয় বিয়ের ভাবনা আসতে শুরু করেছে ক্ষণে ক্ষণে! মা আর কি করবে, না নিজের জীবন সামলাতে পারছেন না নীলার হয়ে লড়তে পারছেন! তবুও মায়ের মন দমে থাকার নয়! নিজের মেয়ের এহেন কম বয়সে বিয়ে হওয়ার বিষয়টি মানতে পারলেন না! চলে গেলেন বাবার সাথে কথা বলতে,
- ও আমাদেরই মেয়ে! তুমি কেনো ওকে এতো কম বয়সে বিয়ে দিতে চাচ্ছো? (মা)
- শোনো! আমি তোমার আর তোমার মেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত! দয়া করে আমার মন আরও বিষিয়ে তুলো না! আমি এক বড়লোক বাপের ব্যাংকার ছেলের সাথে ওর কথা ঠিক করেছি! এটাতে বাগড়া দিয়ে আমার যন্ত্রণা আর বাড়িও না! নিজেও তো এখন অবধি একটা ছেলে সন্তানের মুখ দেখাতে পারলে না! আর এসেছো সাফাই গাইত! ( বাবা)
বাবার কথায় কষ্ট পাওয়াটা এখন আর নতুন কিছু নয়, কিন্তু বুকটা যেনো মোচড় দিয়ে ওঠে মেয়ের প্রতি বাবার এহেন অবহেলা, বিরক্ত দেখে! মা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের জীবনটা তার জীবনের মতো হবেনা! নীলা নতুনভাবে বাঁচবে! তাই সিদ্ধান্ত নিলো আজ রাতেই গ্রাম থেকে পালাবে মেয়েকে সাথে নিয়ে! যেই ভাবা সেই কাজ।
ভোরের আলো ফুটতেই গ্রাম শুদ্ধু এ খবর রটে গেলো নীলার মা পালিয়েছে নীলাকে নিয়ে! নীলার বাবা বাকি তিনটে মেয়েকেও ঘর ছাড়া করলো, দায়িত্ব পরলো নানা নানীর উপর! তাদের অবশ্য সমস্যা নেই, কারণ মা বলে গিয়েছেন-
-অপেক্ষা করিস নানু বাড়িতে, আমি আর আপু কিছুদিন পর ঠিকই তোদের নিতে আসবো! (মা)
এদিকে গ্রাম থেকে একা দুটো মেয়ে পালানো যে কতবড় ঝুঁকি এবং কষ্টের কারণ হতে পারে তা না জানা নীলা আর নীলার মা আশ্রয় নিলো রংপুর শহরের এক এলাকায়! প্রথম প্রথম একা মেয়ে মানুষ ভেবে বাড়ি ভাড়া দিতে না চাইলেও শেষমেষ দোতলা বাড়ির ছাদে একটি ঘর তাদের জন্য বরাদ্দ করে দিলেন স্বয়ং উপরওয়ালা! কথা হলো নীলারা চলবে কিভাবে! আসার সময় নিজের বিয়ের গহনা কয়টা আর কিছু জমানো টাকা সাথে নিয়ে এসেছে নীলার মা! আর এইচএসসি অবধি পড়াশুনা থাকায় কিছু একটা করে নেবে এই ভরসায় তার এতো বড় পদক্ষেপ!
শুরুটা সহজ ছিলো না, তবে কিছুদিন পর একটা কিন্ডারগার্টেনে মায়ের শিক্ষিকার চাকরিটা তাদের কষ্ট কমিয়ে দিলো! মায়ের যত্নে বাবার অবহেলার দিনগুলো যেনো ভুলে গেলো নীলা! বেশ মেধাবী হওয়ায় নীলার প্রতিবার বৃত্তির টাকাটা মা ব্যংকে জমা করতে শুরু করলেন! মেয়ে আমার বড় হচ্ছে, এই ভেবে তার ছোট ছোট সঞ্চয়ী একাউন্ট খোলার তোর জোর লেগে গেলো! ছোট বোন তিনটার নানু বাড়িতে খরচ, পড়াশুনা সবই চলতে থাকলো ভালোভাবে! নানুর পেনশনের টাকায়
নীল তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে! একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে মাকে ডাকলেও সারা শব্দ না পেয়ে নিজের কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে খেতে বসতেই হুট করে এক অজানা নম্বর থেকে ফোন এলো, ধরতেই ওপাশ থেকে অজানা কেউ বলে উঠলো
- আপনার নাম কি নীলা? আপনার মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে! গুরুতর আহত দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন!
নীলার সুখের জীবনে কোনো এক ঝড়ের মতো সব দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে মায়ের এক্সিডেন্টের খবর যেনো তার শরীর কাঁপিয়ে দিলো! হৃদয়ে অপার্থিব দুশ্চিন্তা আর ভয় তাকে ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে।
হাসপাতালে পৌঁছাতেই জানতে পারলো মায়ের চিকিৎসায় ১.৫ লাখ টাকা প্রয়োজন! অকুল পাথারে নীলা কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে রইলো হাসপাতালের বারান্দায়।
কি করবে সে! কোথায় পাবে এতো টাকা! নানুকে ফোন করে জানাতেই তাদের মাথায় বাজ ভেঙে পরলো! নীলার মায়ের পাঠানো স্বল্প কিছু টাকা আর নানুর পেনশনে এতোদিন চলতো তারা! কোথায় পাবে এতো টাকা! হুট করেই কি মনে করে যেনো বাবাকে ফোন দিয়ে বসলো নীলা, বাবার নম্বরটা কি এখনো চালু আছে? ভাবতে না ভাবতেই ফোনের ওপাশ থেকেই এক নারী কন্ঠ শুনতেই নীলা বুঝলো বাবা আর একটা বিয়ে করেছে!
বাবাকে দিতে বললে,কর্কশ সুরে নারীকন্ঠ বলে উঠলো,
- মান ইজ্জত তো যা খাওয়ার খেয়েছো মা মেয়ে! এখন আবার টাকা চাইতে এসেছো! লজ্জা নাই?
এমন তিরস্কার শুনে শেষ আশাটুকুও যেনো শেষ হয়ে গেলো! নিজের জীবনের করুণ পরিণতি তার সামনে ভাসতে শুরু করলো।
শেষ অবধি অর্থাভাবে মাকে হারানোর মতো নিদারুণ কষ্ট এই অল্প বয়সে তার হাসি খুশির অনুভূতিকে যেনো নিঃশেষ করে দিলো! মায়ের চলে যাওয়ার পর নিলার দিনগুলো যেনো একটা করে বছর সমান হয়ে উঠলো! বোনদের দায়িত্ব, নিজের পড়াশুনা, সামাজিক অবহেলা তাকে যেনো কম বয়সেই জীবনের নিষ্ঠুরতা দেখাতে শুরু করলো!
নিজের ক্লাসের ফাঁকে টিউশন আর কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের খাওয়ার আর বোনদের পড়ার টাকাটা দিতে পারলেও নিজের জন্য কিছু কেনার শখ আল্লাদ যেনো কর্পূরের মতো উবে গেলো! তার মধ্যেই নানুর মৃত্যু তার জীবনকে আরও দূর্বিষহ করে তুললো!
খুব কষ্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ তৈরি করার পর তার কষ্টের কিছুটা লাঘব হলো, যখন বাকি বোনগুলোও বেশ বড় হয়ে নিজের খরচ নিজে চালাতে শুরু করলো!
তখন সাল ২০১৫, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিউশনি যাওয়ার রাস্তায় কিছুদিন ধরে কয়েকটা ছেলে খুব বিরক্ত করছিলো নীলাকে! আজও বেশ ভয়ে ভয়ে এগোতে থাকলো সে সামনের গলিটা ধরে! এই না আবার চলে আসে! ভাবতে না ভাবতেই সামনের এক ঝুপড়ি থেকে বখাটে দলের দুটো ছেলে বেরিয়ে এলো!
- কিরে! তুই তো পাত্তাই দিচ্ছিস না! এতো ভাব কিসের!( বখাটে)
ভয়ে নীলার গলা শুকিয়ে কাঠ! হুট করেই পিছন থেকে এক পুরুষকন্ঠ তার কানে বেজে উঠলো!
-মেয়েদেরকে রাস্তায় একা পেলে এসব করা লাগে কেন তোদের? ভার্সিটির এলাকাতে এসব করার সাহস পাস কোথায়! কর্তৃপক্ষকে বলে একদম জেলে ভরে দেবো!
কথাটা শুনতেই ছেলেগুলো একটু ভয় পেয়ে কেটে পরলো! পিছনে ঘুরতেই নীলা দেখলো লম্বা, চওড়া, সুদর্শন এক ছেলেকে! খাড়া খাড়া চুল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের একটি!
ওর নাম আপন! নীলার ভার্সিটিরই! ল’ নিয়ে পড়ে! ভার্সিটির ভালো ছাত্রদের তালিকায় তার নামটা আছে, বেশ জনপ্রিয় মানুষ! প্রথম পরিচয়ে নীলার মনে সফট কর্ণার তৈরি করে ফেললো বেশ!
- সামনের রাস্তাটুকু একসাথে যাই? কি বলেন?[ আপন]
নীলাও না করলো না! প্রথম দিনের খোশ আলাপের পর থেকে সখ্যতা বাড়তে থাকলো দুজনের! কথা হলো ম্যাসেজে ফোনে! যেনো নীলার দূর্বিষহ জীবনে একটু শান্তি ফিরে আসলো! আপন তার নামের মতোই নীলাকে আপন করে নিলো!
বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে যখন দুজনে চাকরির প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত নীলার নানী মারা যায়! ছোট বোনগুলো ততদিনে বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় শহরে চলে আসে! সবাই মিলে যেনো কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলো জীবনে!
আপন আর নীলার বিয়ের কথা উঠলে পরিবারের মাঝে কিছুটা অমত দেখা দিলেও আপন তা নিজ হাতে সামলে নিলো! যেনো নীলা তার অবিচ্ছেদ্য অংশ! নীলা আর আপনের এর মাঝেই ছোট খাটো একটা চাকরি জুটে গেলো! বছর পেরোতেই আপনের ভালো একটা ল ফার্মে চাকরি হয়ে যাওয়ায় বিয়ে নিয়ে তোর জোর শুরু হয়!
বিয়ের প্রস্তুতির মাঝেই নিজের মায়ের কবরটা একবার দেখার জন্য নীলা গ্রামের দিকে রওনা হয়! মায়ের কবরের সামনে দাড়িয়ে বলে
- মা, তুমি তো আমাকে খুশি করতে গিয়ে নিজেকে শেষ করেছো! অবশেষে আমি একটু শান্তি পাবো মা! তুমি দোয়া করো আমার জন্য!
সাথে নানু নানীর কবরটা জিয়ারত করে ফিরে আসতে খানিকটা সন্ধ্যে হয়ে গেলো!
একা রাস্তায় বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিলো নীলা! দূর থেকে কারো একটা অবয়ব তার চোখে পরলো! বাঁকা হাসি দিয়ে এগিয়ে আসছিলো তার দিকে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলার মাথায় পাথর দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলো সে! নীলার নিথর দেহটা পরে রইলো!
যেনো উপরওয়ালা তার শেষ সুখটুকু তাকে দিতে চাননি! শেষ মূহূর্তে হয়তে নীলার একটুকরো শান্তির আশা রয়ে গিয়েছিলো! মৃত্যুর আগের সাতটা মিনিট সে কি ভেবেছিলো কেউ জানেনা! কিন্তু বাঁচার আকুতি হয়তো ছিলো পুরোটা জুড়ে! আজ যখন শান্তি তার হাতের নাগালে ছিলো নিয়তি তার সাথে ছিলো না!
পরদিন গ্রামে খবর পরলো একা রাস্তায় এক মেয়েকে মেরে তার সব লুটে নিয়েছে এক ছিনতাইকারী! আপন হয়তো ভাবেনি নীলা আর ফিরবেনা! শেষ সময়ের কথাটুকু তার মনে পরছিলো বার বার
- কিছুদিন পরে গেলে হয় না?[ আপন]
- আরে বাবা আমি দ্রুত চলে আসবো [নীলা]
নীলা তার কথা রাখলো না! আপন নীলার কবরের পাশে দাড়িয়ে সাথে নীলার তিনটে ছোট বোন!
আপন মনে মনে বললো, একবারের জন্যও কি আমাকে তোমার মনে পরলো না? আমাকে এভাবে একা ফেলে যেতে কষ্ট হলো না? এতো বড় ধোঁকা! নীলা তুমি কথা রাখোনি! সবটুকু কষ্ট নিজে সহ্য করে বিদায় নিলে! আমার সাথে এমন না করলেও পারতে!
নীলার কবরে লাগানো ফুলটা হালকা বাতাসে নড়ে উঠলো!
হয়তো নীলা বলেছে, আমি আছি সবসময় তোমাদেরই সাথে!
Author details:
Name: আসমাউল হুসনা তৃপ্তি
Email: asmaultripty08@gmail.com
Grade: Rajshahi University of Engineering and Technology, 2nd Year
Department: EEE