Published Date: 15/02/2025
জারিফ চৌধুরী
১.তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।
আনিস হাইওয়ের কিনারা ধরে হাঁটছে, তার হাঁটার ভঙ্গি অনেকটা উদ্ভ্রান্ত ও আতঙ্কগ্রস্থ। কিছুক্ষণ আগেই সে একটি বুড়ো লোককে ট্রাকের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। না, ভুল হলো, কাজটা সে করেনি, কাজটা করেছে তার হাত, তার নিজের হাত, যে দুই হাত নিয়ে যে পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় কি যে সে ‘নিজের হাতে’ কাজটি করেছে? আনিস ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সব নষ্টের মূলে এই হাত, সমস্যার শুরুটা সেদিন যেদিন থেকে আনিসের হাত আনিসের সাথে কথা বলা শুরু করল।
২.প্রায় দুই সপ্তাহ আগের কথা,
অফিস থেকে বসের ঝাঁড়ি খেয়ে বাসায় ফিরছিল আনিস। মেজাজ তীরিক্ষী হয়ে আছে।
বাসের মাঝামাঝি জানালার পাশের সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল সে, হঠাৎ সে শুনতে পেলো কে যেনো বলে উঠলো,
“কীরে? মেজাজ খারাপ? সিগারেট টান, মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যাবে।”
আনিস চমকে উঠে তার পাশের সিটের দিকে তাকালো।এক বুড়ো লোক বসে আছে, তাঁর গলার আওয়াজ স্বর কখনওই আনিসের শোনা স্বরের মতো হওয়া সম্ভব নয়।
“আরে ব্যাটা, আমি তোর হাত, ‘আমার’ দিকে তাকা।”
আনিস চমকে তার হাতের দিকে তাকালো, সেখানে কিছু নেই। সে হাফ ছাড়লো, সে কি ভেবেছিল সেখানে চোখ মুখ দেখা যাবে?
“নাহ, কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে হবে,” ভাবল আনিস।
বাড়ি ফিরে যে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল, তখনই তার হাত আবার বলে উঠলো,
“কীরে? আমাকে মনের ভুল মনে করছিস? আমি তোর হাত রে।”
এবার আনিসের খটকা লাগল, সেকি পাগল হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু স্বরটা এত চেনা চেনা লাগছে কেন? এই স্বর তার অতি পরিচিত জনদের মধ্যে একজনের। আনিস শিউরে উঠল। সে নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাচ্ছে। নাহলে এমন একজনের গলার স্বর সে কেনো শুনবে যাকে সে দুবছর আগে নিজ হাতে……..
৩.দু বছর আগের কথা,
আনিস ও তার বন্ধু জাভেদ সবেমাত্র একই কোম্পানিতে জয়েন করেছে। তারা স্কুল জীবন থেকে বেশ ভালো বন্ধু, কোম্পানিতেও তারা বেশ দক্ষতার সাথে কাজ করছিল, পদোন্নতিও তাদের নাগালের মধ্যে ছিল। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আনিস যাকে তার ভালো বন্ধু ভেবেছিল, সেই জাভেদ আনিসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ দিয়ে প্রমোশন বাগিয়ে নেয়। আনিস চাইলে জাভেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারত, কিন্তু সে তা করেনি। করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বন্ধুটির বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিয়ে ছিল। শুধুমাত্র পুরোনো বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু জাভেদ হয়তো তা চায়নি, সে আনিসকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে শুরু করে। আনিসও আর কথা বাড়ায়নি। কয়েকমাস পর, জাভেদ হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় তার ‘প্রাক্তন’ বন্ধু আনিসকে তার বাড়িতে ডেকে নেয়। আনিস ভেবে ছিল হয়তো সব ভুল বোঝাবুঝি মিটমাট করা হবে, আনিস হাসিমুখে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। রাতের খাবার খেয়ে তারা যখন ড্রিংকস করতে করতে পুরোনো দিনের গল্প করছিল, আনিস এমনকি তখনও ‘না’ বলেনি। রাত বেশ গভীর হয়ে যাচ্ছিল।
আনিস বলল, “দোস্ত, এবার বাসায় যেতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেছে।”
“আরে যাবি তো। খুব রাতও হয়নি। আয় নিচ থেকে সিগারেট কিনে নিয়ে আসি।”
আনিসের বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি সবকিছু জাভেদের প্ল্যানমাফিক হচ্ছে, সিগারেট কেনার পর জাভেদ আনিসকে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে যায়, আনিসের মনে তখনও কু-ডাক দিলেও তা সে গ্রাহ্য করেনি।সেদিন রাতে যে গলিতে তাদের মধ্যে সে কথোপকথন হয়েছিল তা আনিস জীবনেও ভুলবে না। জাভেদ প্রথমেই জানায় যে তার চাকরি চলে গেছে। যদিও এটার অফিসিয়াল নোটিশ আসেনি, তার বিরুদ্ধে নাকি দুর্নীতি ও অসৎ উপায়ে পদন্নতির অভিযোগ করেছে কেউ। শুধু জাভেদ নয়, অন্য কেউ হলেও ধরে নিত কাজটি আনিস করেছে, জাভেদ ব্যতিক্রম নয়, সে প্রথম সুযোগই অভিযাগ তুলল আনিসের বিরুদ্ধে, তারা হয়তো ড্রিংক বেশিই করে ফেলেছিল। তাই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সেখানেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু করে তারা।তর্কের সময় জাভেদ বারবার আনিসকে বলছিল দোষ স্বীকার করে নিতে।
আনিস বরাবরই অস্বীকার করে যায়। বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে জাভেদের হাত যে বস্তুটি উঠে আসে, আনিস আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে যেটি দেখে। জাভেদ যখন ছুড়ি হাতে অসংলগ্ন পায়ে আনিসের দিকে এগিয়ে আসছিল, আনিস তখন দুঃখ ও ক্ষোভে ফুটছিল। পানাহার বেশিই হয়ে গিয়েছিল হয়তো সে রাতে। ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে আনিস যে কাজটি করে ফেলে সে রাতে, স্বাভাবিক অবস্থায় সে তা চিন্তাও করতে পারত না। আনিস ছোড়াটি ছিনিয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থকে জাভেদের শরীরে।আনিস যখন শান্ত হয়, ততক্ষণে জাভেদ ভবলীলা সাঙ্গ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। জমিয়েছে। আনিস জাভেদের লাশের সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তখন তার মাথায় কী চলছিল তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। জাভেদ ছোড়াটি নিয়ে তার বাসায় চলে আসে। না, জাভেদের খুনিকে কখনওই পুলিশ খুঁজে পায়নি। খুজে পেলেই হয়তো ভালো হতো, তাহলে আনিসকে বর্তমান সময়ে এত সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না, জাভেদকে হত্যার চাপ ও বোঝা বয়ে বেড়াতে হতো না এতো বছর।
৪.বর্তমান সময়।
আনিসের ‘হাত’ আনিসকে বেশ ভালো রকম ভোগানো শুরু করে। গত দুই মাসে এটি আনিসকে দিয়ে এমনসব কাজ করিয়েছে, যা আনিস নিজে করতে জীবনেও সাহস পেত না। আনিস বলতে গেলে তার শরীরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এখন সে হাইওয়ের পাশ ধরে হাঁটছে। ‘হাতটা’ ঘুমিয়ে আছে। আনিস ভাবল, “”আর না। আমাকে এ ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হবে।””আনিস চিন্তা করল, এখন তার সামনে দুটি রাস্তা খোলা। তাকে হয়তো তার হাতটি কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু আনিস অসহায়ের মতো বুঝতে পারল, হাত কেটে ফেললেও সে তার কর্মফল ও বোঝা থেকে মুক্তি পাবে না। অনুশোচনায় সে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
আনিস হাসল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কী করবে।
“জাভেদ, শেষ পর্যন্ত তুইই জিতে গেলি।” মনে মনে ভাবল সে।
৫.”এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রম।
এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যাক্তিরা মনে করে তাদের হাত একটি আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বেড়ে উঠছে। রোগের চূড়ান্ত অবস্থায় আক্রান্তরা মনে করে তাদের হাত তাদের শরীরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তবে পুরো পৃথিবীতে এ ধরনের কেস অনেক রেয়ার।” বললেন মন
Author Details:
জারিফ চৌধুরী
শ্রেণি: দশম
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ