ওই! কেমন আছো? (সুপ্তি)
-তুমি রাখছো যেমন। (আপন)
—দেখো অনেক দিন পর ফুপির সাথে দেখা করতে আসছি, বেশি প্যাঁচাবা না কিন্তু! (সুপ্তি)
–প্যাঁচাইছো তো তুমি। এতো করে বললাম, একটু দূরে দূরে থাকবা আমার থেকে, তা নয় জনাবা কে আমার আশেপাশে থাকাই লাগবে। এই অল্প বয়সে এত পীরিত এর পসরা কই পাও তুমি? কেবল তো ইন্টারমিডিয়েট এর ধেড়ি মাইয়া! তুমি জানো না? তোমার উপস্থিতি আমার কাছে স্বর্গের বাতাসের মত সুগন্ধময়, মর্ত্যের মহাসমুদ্রের মত বিশাল!
[একটু জিরিয়ে নিয়ে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে]
তাইতো তোমার ভালোবাসার প্যাঁচে, তোমার ঐ ঘন কালো লম্বা চুলের বেনুণী’র প্যাঁচে ধপাস করে পড়ে গেলাম; নিজের অজান্তে বাঁধা পড়লাম তোমার প্রণয়-শেকলে। তাইতো তোমার ভালোবাসার প্যাঁচে, তোমার ঐ ঘন কালো লম্বা চুলের বেনুণী’র প্যাঁচে ধপাস করে পড়ে গেলাম; নিজের অজান্তে বাঁধা পড়লাম তোমার প্রণয়-শেকলে। (আপন)
—নিজে তো অনার্স থার্ড ইয়ারের কামলা জোয়ান। পারো নাই তো নসিবে একটা মেয়ে জুটাইতে। তখন চেহারা দেখে মায়া বলেই তো তোমার প্রেমিকার গুরুদায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিলাম।
[অকস্মাৎ মুড স্যুইং করে…]
শালা তোর সাত কুলের কপাল যে আমারে প্রেমিকা হিসেবে পাইছোস! (সুপ্তি)
—‘শালা’ করে বললি রে? মুখের ভাষায় এত তিক্ততা কোত্থেকে আমদানি করলি? মামাকে বলতে হয় তাহলে তার কন্যার বিশ্রী বচন সম্পর্কে। (আপন)
—যা বল গে। ফুপি কই? হ্যাঁ? (সুপ্তি)
[তৎক্ষণাৎ আম্মুর আগমন]
–হ্যাঁ রে মা! তুই আসছিস? কী অবস্থা তোর? (আম্মু)
—হ্যাঁ আম্মি ভালো। তুমি? (সুপ্তি)
—হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ। তা হঠাৎ এতোদিন পর এখানে? (আম্মু)
—ও মা! এখানে আসা আমার মানা নাকি আম্মিজান? আগে জানলে এদিকে পা মাড়াতাম না। (সুপ্তি)
[কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে সুপ্তি’র কৃত্রিম ক্ষোভের উদগীরণ]
—এ মা! তুই মন খারাপ করিস ক্যান? আমি সেভাবে বলি নি। আমি-ই তোরে ছোটকালে সন্তানের মতো স্নেহ-মমতা দিয়ে মানুষ করলাম। স্বভাবতই তোকে একটু বেশি মিস করি। এতো নিকটেই থাকি তোর। দশটা বাড়ি পার হলেই তো ছুটে আসতে পারিস আমার কাছে। আমি কি তোকে কোনো অংশে আপন-এর চেয়ে কম মনে করি? কোনো মেয়ে তো নাইআমার। অতএব, ঐটা [আমার তরে ইশারা প্রদর্শণ করে] আমার ছেলে হলে তুই-ই আমার মেয়ে। ঠিক আছে? আমার সাথে কোনো বিষয়ে দ্বিধা করবি না। আমি তো পারলে সারা জীবনের জন্য তোরে আমার কাছে এই বাড়িতে রাখতে চাই। (আম্মু)
[আচমকা আম্মু’র কথায় দুজন-ই চমকে গেলাম।]
আম্মু’র চোখে জলরাশি চিকচিক করছে। সুপ্তি’র নয়নেও অশ্রুবর্ষণের এক পশলা মেঘ। আম্মু’র কথা শুনে তার ফর্সা গালে লাল আভার লালিমা ছেয়ে গেছে, যেন মেঘলা শরতের সাদা আকাশে এক ফালি সোনালী রোদের আস্তরন ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আম্মু আর সুপ্তি—-দুজনেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে। সুপ্তি গিয়ে ঠাঁই নিলো তার আম্মিজানের বুকে। আম্মুও পরম আদরে তার লালিত-পালিত মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
তবে আম্মু’র শেষ বাক্যটাও এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়। এর মানে আম্মুও সুপ্তি-কে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যপারে রাজি। সরাসরি মুখে না বললেও তার কথার ধাঁচে আর বলার দৃপ্ততায় এমনটাই অনুমান করা যায়।
[অতঃপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক।]
–সুপ্তি, আজকে কি খাবি মা? আমাকে বল। ইলিশ মাছের পাতুড়ি নাকি রুই মাছের মুড়িঘণ্ট নাকি খাসির মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে দিবো? (আম্মু)
[ফুপি-ভাতিজির কথোপকথনের মধ্যে আমার বাগযন্ত্রে খই ফুটলো]
-আম্মু, বিরিয়ানি রাঁধো। সাথে দেশি মুরগির রোস্ট কইরো। সুপ্তি’র ফেভারিট। ফ্রিজে দই আছে, ওটা রোস্ট এ দিও। (আপন)
-রাজনীতি করিস না। তোর নিজের এগলা খেতে মন চায়, তা বললেই পারিস। অযথা নিজে অপরাধ করে সেই দোষে আমার মেয়েটাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছিস কেনো?
[সুপ্তি’র দিকে ঘুরে]
তুই বল মা! (আম্মু)
—আম্মি আমি আসলে ওর [আপন] কাছে এইচএসসি’র কিছু সাজেশন আর একটা ব্যকরণ বই নিতে আসছি। নিয়েই দ্রুত চলে যাব। আব্বুকে জানায় আসিনি। রাগ করবে দেরি করে ফিরলে। (সুপ্তি)
–আচ্ছা মা তোর যেটা দরকার আপন-এর কাছ থেকে নে।
[আম্মু তড়িঘড়ি করে প্রসঙ্গ পাল্টে…]
আর আপন? (আম্মু)
আম্মু? (আপন)—সুপ্তি রে আজকে বিকেলের আগে যাইতে দিবি না। আমি এখনই তোর মামাকে ফোন দিয়ে ওর থাকার কথা বলে দিচ্ছি। সন্ধ্যায় ওরে বাসায় পৌঁছায় দিবি। এখন তাহলে সাজেশন দে, আমি কিচেনে আছি। (আম্মু)
এই ফাঁকে তাহলে পরিচয় পর্বটা সেরে নেওয়া যাক। আমি সেজান শাহরিয়ার আপন। বাবা চাকরির সুবাদে দিনের বেলা অফিসে থাকলেও আমি-বাবা আর মা মিলে রাতের আহার টা একত্রে সম্পন্ন করি। পরিবারের সদস্য বলতে এই তিন জনই। তবে আমার ডিমে ভাগ বসানোর জন্য আর চুলোচুলি-হাতাহাতি করার জন্য আরেকজন শত্রু এ বাড়িতে ছোটবেলায় ছিলো। সেই মহীয়সী-ই হচ্ছে সুপ্তি।
আমার আম্মু-রা দুই ভাই-বোন। তাদের দহরম মহরম সম্পর্ক দেখে যে কারোর-ই হিংসায় পিত্তি জ্বলে ওঠার উপক্রম। মামার বাড়ি আর আমাদের বাসস্থানের সর্বোচ্চ দূরত্ব দুইশ’ মিটারের কিছু অধিক। পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটে এখান থেকে ওখানে তরকারি আদান-প্রদান হয়।
আর যিনি এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু–
-‘সুপ্তি’; মামার একমাত্র অন্ধের যষ্টি নন্দিনী। সে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো একজন। আলালের ঘরের দুলালী। যথেষ্ট সোহাগ-স্বাচ্ছন্দ্যে পৃথিবীতে আসলেও তার বেড়ে ওঠাটা সে তুলনায় ছিলো ভয়াবহ অমসৃণ। হয়তো অর্থ-খাদ্যের অভাব, মৌলিক চাহিদার অভাব তার উপলব্ধি করতে হয় নি, চাওয়ার আগেই মামা তার দোরগোড়ায় সবকিছুর যোগান দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন। মামার অঢেল সম্পত্তির একচ্ছত্র উত্তরাধিকারিনী হওয়া সত্ত্বেও তার হৃদয়ে যেন এক রাশ রিক্ততার হাহাকার।
জন্মের দ্বিতীয় বছর পেরুতে না পেরুতেই সে তার মা-কে হারায়। মা কি অমূল্য রতন—তা বুঝার আগেই মাতৃবিয়োগের শোকে তার শিশুমন রীতিমত মূর্ছা যায়। ক্ষুধার জ্বালা আর মা-হারানোর দুঃখ-গাথা তার চোখ দিয়ে রক্তের ন্যায় অশ্রুবন্যা হয়ে ঝরে।
ভাতিজি’র এমন বিষাদ হয়তো আমার আম্মু’র সহ্য হয় নি। তাই তিনি সুপ্তি-কে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের গৃহে। চেয়ে এনেছিলেন মামা’র কাছ থেকে।
বেঁচে আছি জীবন্ত লাশ হয়ে। যে লাশ না যায় কবর দেওয়া, না যায় পৌরবর্জ্যের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া।
আমার আত্মা সারাটা জীবন সুপ্তি’র জন্য কেঁদে যাবে। তার মৃত্যুর সেই দিশেহারা ঘটনা আমাকে বেদনা-বিধুর করে তুলবে সারাদিন সবসময়—–
“Time marches on
But memories stays
Torturing silently
Rest of our days.”
তবে এবার সময় এসেছে পরিবর্তনের, ক্ষণ এসেছে পালা বদলের। রাশিয়ান লেখক ইভান তুর্গনিভ বলেছিলেন—“ভালোবাসার জন্য সমগ্র জীবনের দরকার নেই। ভালোবাসতে একটা মুহুর্ত, একটা প্রহর-ই যথেষ্ট, যদি সে ভালোবাসা শতভাগ খাঁটি হয়।”
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আসলে পূর্ণতা দিয়ে সকল ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। পূর্ণতা দিয়ে বিচার করতে গেলে ভালোবাসার প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। তবে ভালোবেসে কাউকে না পাওয়ার নিষ্ঠুরতা তেও মিশে আছে এক অন্যরকম মিষ্টতা। তার ক্ষণকালের সঙ্গ লাভের সৌভাগ্য টাকেই সারাজীবন স্মৃতি হিসেবে বয়ে বেড়ানো যায়।
প্রাপ্তিতেই সব ভালোবাসার স্বীকারোক্তি অকপট হয় না। কিছু কিছু ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে আশ্রয় নিতে হয় যাতনাময় বিচ্ছেদের। বিশেষ ক্ষেত্রে ভালোবাসা না পাওয়াটাই সুন্দর-শোভনীয়। পেয়ে গেলে আমরা তার অবমূল্যায়ণ করি, না পেলে আমরা ভালোবাসার মানুষটির সাধনা করি।
সুপ্তি কে আমি আমার হৃদয় মন্দিরে দেবী’র আসনে বসিয়েই তার সাধনা করে যেতে চাই সারাটা জীবন। তাতে আমার কপালে পুর্ণর্বার পূজা করার নতুন কোনো প্রতিমা জুটবে নাকি জুটবে না—-সেই দোলাচলেই আরতি দিয়ে আমি সুপ্তির সাথে নীরবে পার করে দিতে পারবো সুদীর্ঘ এক জনম!
Author details:
Arman Hossain Prince
Khulna University of Engineering and Technology
Department : EEE
Year: 3rd