বিহঙ্গ

Mahadi Hasan

Published: 07/09/2024

আমার ঘরের জানালা দিয়ে একটা কদমগাছ দেখা যায়। কদম গাছ অবশ্য দেখার মতো কোন গাছ না। সারা বছর শুঁয়োপোকায় ভর্তি থাকে গাছটা। বাবা একবার রাগ করে গাছটা কাটতে গিয়েছিলো। আমি জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম গাছটা কেটো না। কারণটা পরে বলব।

আমাদের বাসাটা দোতলা, জৌলুসহীন, সাদামাটা। একটা ঘটনার পর থেকে আমি বাসাটায় অসুস্থ একটা গন্ধ পাই। আগে এই গন্ধটা ছিলো না। আমার ঘরের জানালা দিয়ে যে ডালটা দেখা যায়, ওই ডালে প্রতিদিন একটা শালিক পাখি এসে বসে। প্রতিদিন যেন হাজিরা দিয়ে যায়। আজ আমার তেমন কোন কাজ নেই তবু উঠে বসলাম। অনেক সময় নিয়ে নকল পা-টা পরলাম। আসলটার মায়া অনেক আগেই ছাড়তে হয়েছে। আন্দোলনের সময়, একটা বুলেট সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। গ্যাংগ্রিন হওয়ায় পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। আমি বিশেষ দিন ছাড়া নকল পা পরি না। আজকে কি কোনো বিশেষ দিন?

পাখিটা আজকে আসতে দেরি করছে। মাঝে মাঝে পাখিটা এমন দেরি করে। পাখিটা বেশিক্ষণ থাকেও না। আমি চোখ বন্ধ করে পাখিটার কথা ভাবতে লাগলাম। পাখিটার সাথে মুগ্ধেরএকটা মিল আছে। মিলটা ঠিক কোথায় আমি ধরতে পারছি না। বাদামি ডানা, কালো চোখ, সাদা পালক পাখিটা অনেক সাধারণ। কিন্তু পরিস্থিতি পাখিটাকে বদলে দেয়।খুট করে একটা শব্দ হলো। চোখ খুলে দেখি পাখিটা এসেছে। পাখিটা কেন জানি আমার দিকে সরাসরি তাকায় না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, তখনই পাখিটা আমার চোখের দিকে তাকালো, কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলাম, আমাদের মাঝে যে শব্দহীন কথোপকখন হলো তা প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। পাখিটা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম পাখিটার ডানায় রক্তের ছোপ।

আমি নকল পা নিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসা থেকে বের হলাম। পাখিটা দেখি গাছের নিচে পড়ে আছে; রক্তাক্ত একটা জবার মতো। আমি হাটু গেড়ে পাখিটার কাছে বসলাম। পাখিটাকে হাতে নিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। আমার সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের পানি স্রোতের মতো গড়িয়ে রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

আমি পাখিটাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ মুগ্ধের কথা মনে পড়লো। আমি মুগ্ধকেও এভাবে জড়িয়ে রেখেছিলাম কয়েকদিন আগে। এক পশলা গুলি, সবকিছু বদলে দিল। একটা বুলেট, আমার পায়ে একটা আর মুগ্ধের বুকে একটা। একটু আগেও তো আমরা ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলাম, গলা ফাটাচ্ছিলাম। একটা সাধারণ বুলেট আমাদের নিশ্চুপ করে দেবে? একটা বুলেট সবকিছু বদলে দিল। যখন ওরা গুলি চালালো তখন মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেখানে পারে পালিয়ে যাচ্ছিল। একটু আগেও তো মুগ্ধ “পানি লাগবে পানি” বলে চিৎকার করছিলো। একটা মানুষ কখনও এতটা স্বার্থহীন হতে পারে?আমি তখন বুলেট লাগা পা আর মুগ্ধকে কে কোলে নিয়ে খোঁড়াচ্ছিলাম, সেদিন ও আমার সাদা শার্ট লাল হয়েছিল, রক্তজবার মতো। কারা যেন আমাকে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছিল। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম মুগ্ধকে ও তুলে নিতে। কিন্তু এ শহরে মৃতদের কোন দাম নেই।

পাশে কখন বাবা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। বাবাকে বললাম কদম গাছটা কেটে ফেলতে, আমাদের আর ওটার দরকার নেই।

Author details:
Name: Mahadi Hasan,
Email: 2955hasan@gmail.com
Grade: HSC examinee

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *