আসমাউল হুসনা তৃপ্তি
Published: 12/09/2024
একটা দমকা হাওয়া, প্রবল বেগে ঝড়ে টিকে থাকা সাগর পাড়ের নিতান্তই ছোট্ট একটা আস্তাকুঁড়ে জীবনের চেয়ে মৃত্যু উত্তম! সাগরের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া বালুকণাটার গুরুত্ব আমার জীবনের চেয়ে বেশি! একটা পোষা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার কাছে আমার হৃদয় ভাঙার নিষ্ঠুরতা যেনো ঠুনকো! অধম কোনো প্রাণী কি আছে আমার মতো!
-হুট করে জানালা ভেদ করে আসা দমকা হাওয়ায় যেনো প্রবল শ্বাস প্রশ্বাসের সংকটে পরে গেলো তিথী! তার ঘোর যেনো ভেঙে গেলো এক মূহূর্তে!
হুশ ফিরে জানালার ধারে দাড়াতেই কি মনে করে যেনো চোখ জুড়ে অঝোর বৃষ্টি তার কপোল বেয়ে নেমে গেলো! অতীত নাকি ভবিষ্যত কার জন্য এ কষ্ট! একমাত্র আদরের মেয়ের এরুপ দশা কি মা বাবা জানে! নাহ জানেনা,
তার চেয়ে রাতের এই আঁধার, ঘরের প্রতিটি দেয়াল, তার রোজ সকাল পাঁচটায় সেট করা এলার্মের ঘড়িটা হয়তো তার এ বিষাদ সম্পর্কে জানে!
হয়তো জানে জানালার ধারের জনশূন্য রাস্তাটা সে কত রাত জেগেছে।
হয়তো জানে রাতের অপরুপ সুন্দর তারাগুলো আর তার পাশেই এক ফালি চাঁদটা।
কিংবা তার বালিশটা জানে সে আদৌও ঘুমিয়েছে কিনা!
হুট করে রাত তিনটায় এমন ভাবনা আসাটা তিথীর জন্য নতুন কিছু নয়! হুট করে উঠে নামাজে বসে কাঁদাটাও নতুন নয়! শুধু নতুন হলো তার টিকে থাকা আর বাঁচার আকুতি! আজ বড্ড মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে মন চাচ্ছে তার! বলতে ইচ্ছে করছে, মা তেমার মেয়েটা ভালো নেই! একটা বার জড়িয়ে ধরো না মা! আমার এ কান্না এ হতাশা তুমি নিয়ে নাও না মা! আজ ৪টা বছর আমি ঘুমাতে পারিনা! তুমি জানো মা আমি তোমার পাশে সারাজীবন ছোট্ট তিথীটি হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম! আমি এমন হতে চাইনি মা!
নিজের আবেগ হতাশাকে সংবরণ করতে শিখে গেছে সে! তাই চুপচাপ চোখ দুটো মুছে, একবুক হাহাকার আর বিষন্নতা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো তিথী!
[ পরদিন সকাল ৭টা]
৫টার এলার্ম টা না বাজায় নিজের ক্লাস মিসের ভয়ে দ্রুত ওয়াশরুমের বেসিনে ব্রাশ করতেই আয়নার নিজের চেহারাটা দেখে বড্ড অসহায় মনে হলো! কতোটা হসিখুশি চঞ্চল ছিলো সে! কতোটা প্রাণোবন্ত ছিলো তার চাহনি! নিজের চোখের নিচের কালি যেনো মনে করিয়ে দিচ্ছে নিজের একটু যত্ন নাও আর কত অন্যায় নিজের প্রতি!?
আনমনা হয়ে যেনো নিজের মাঝেই একটু হারিয়ে যাওয়া, নিজেকে আবিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা,
[ ৭টা ৩০ এর এলার্ম বেজে উঠলো]
হুট করেই হুঁশ ফিরে এলো, ওমা দেরি হয়ে যাবে আটটায় কোচিং ক্লাস!
ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তিথী! বাবা মা প্রচন্ড ব্যস্ত হওয়ায় ছোট থেকেই একাাকিত্ব তার প্রিয় সঙ্গী!আবেগ বলে কিছু আছে তার মাঝে এটা আসলে মা বাবার বোঝার মতো সময় বা মন মানসিকতা হয়ে ওঠে না!
বাড়ি থেকে বেরোতেই, পাশের বাড়ির এক হাসি খুশি মেয়ে মুন্নির সাথে তার দেখা!
প্রতিদিন তিথীর জন্য তার একটা রুটিন বরাদ্দ থাকতো!
দেখা হতেই, ” কেমন আছিস? সুস্থ আছিস? খাওয়া দাওয়া করছিস?! তিথীও কোনো রকমে উত্তর দিয়ে কাজ সারতো!
মন্নি মেয়েটা নিতান্তই ভালো মনের মানুষ! কারো সাহায্য লাগবে মানেই সে সবার আগে ছুটে আসবে! এমন সুন্দর মন মানসিকতার এক মানুষকে কে না ভালোবাসবে! তিথীর আবার স্বভাব ছিলো উল্টো, সে কারো জন্য ঝামেলা বাড়াতে চাইতো না জীবনে! তার পিছনের কারণটা নাহয় অজানাই থাক! সবসময় মুন্নিকে প্রশ্ন করে বসতো,তুই নিজেরটা দেখিস না কেনো! তুই নিজের ভালো না দেখে মানুষের ভালো করতে যাবি কেনো! কি দরকার!
মুন্নি শুধুই হাসতো- আরে এমন ভাবতে হয় না, you should charish the beautiful person inside you’
একবার তিথীর পরীক্ষার মাঝে প্রচন্ড পেট ব্যাথা হওয়ায়, মুন্নি তাকে নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছিলো নিজের পরীক্ষা বাদ দিয়ে! তিথী আজও ভেবে পায় না এই মেয়ে কি পাগল! এরকম করলো কেনো! জিজ্ঞেস করতেই মুন্নি হেসে বললল, আরে তুই আমার ফ্রেন্ড না? Friends are family, এতো ভাবিস না ও পরীক্ষা পরে দিয়ে দিবো!
এভাবে দিন যায় রাত আসে! তিথী তার প্রতিদিনের রুটিনে এগিয়ে চলেছে! হতাশা- বেঁচে থাকা- হতাশা!
এর মাঝে মুন্নি বেশ কয়েকদিন হলো কোচিং যায়নি! কিছুটা বন্ধুত্বের খাতিরে তিথী দেখতে যাওয়ায় ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয় উঠতে না পারলেও হাসিমাখা মুখ নিয়ে মুন্নি বললো- তুই আসছিস! আরে বস বস, এই সামান্য জ্বর বুঝলি, ঠিক হয়ে যাবে!
[ বেশ গম্ভীরমুখে তিথী তাকিয়ে রইলো]
- আবার কার উপকার করতে গেছিলা তুমি? নিজের ভালো কি বুঝবানা? এতো মানবদরদী হওয়া লাগে তোমার! [ তিথী]
- আরে তেমন কিছু না, বাড়ির সামনে কুকুরটা বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো! কার সহ্য হয় বল! আমি তাকে আনতে গিয়ে দেখি তার ছানাপোনারা দূরে আটকে আছে এক জায়গায়! খুব মায়া হলো জানিস তো! তাই আর কি ওদের খুঁজে আনলাম![ মুন্নি]
[ স্পষ্ট কাতরতায় তার মৃদু হাসার চেষ্টা]
বেশ রেগেমেগে তিথী – হইছে এখন ঔষুধটা ভালো করে খা! আর ক্লাসে ফিরতে হবে সুস্থ হ দ্রুত!
সেদিন বাড়ি আসার পর, নিজেকে নিয়ে হতাশা যেনো আরও বাড়তে থাকলো তিথীর! আজ আর পারছিনা! রাত তিনটে নাগাদ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো সে! আজ আর বাঁচতে চাইনা, ঘুমের ট্যাবলেটগুলো হাতে তুলে নিতেই থমকে গেলো!
[ পরদিন সকাল]
মুন্নি আজও সুস্থ হলো না, তিথী বেশ দুশ্চিন্তাতেই পরে গেলো, কি হলো এই মেয়ের!
তার বাড়ি গিয়ে দেখলো কিছুটা সুস্থ হয়েছে!
এই কিছুটা সুস্থতার মাঝেই তিথীর জন্য তার বরাদ্দকৃত রুটিনটা চালু হয়ে গেলো,!
তিথী ভেবে পায় না, নিজে সে শয্যাশায়ী অথচ সে তিথীকে নিয়েই ভাবছে!
এমন মানুষও হয়!
বাড়ি এসে মা বাবার লড়াই যেনো তিথীর মানসিক অবসাদকে দ্বিগুণ করে দিলো!
মা বাবা দুজনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন!
সেদিন রাত তিনটায় তিথী প্রচন্ড মানসিক চাপে পরে যায়, তার চোখ দুটো যেনো ঘোলা হয়ে আসছে! আজ সর্বনাশ ঘটবেই!
— এ পৃথিবীতে কেউ কি আছে যে আমার চেয়ে অধম! আমি কেনো নিজেকে ভালোবাসি না! আচ্ছা আমি মরে গেলে তো কারোরই যায় আসবেনা! কেউ কাঁদবেনা! বরং সবাই বেঁচে যাবে!
ভাবতেই ভাবতেই নিজের খাওয়া ঘুমের ঔষুধের ঘোরে আটকা পরতে থাকলো তিথী!
হুট করেই মুন্নির চেহারাটা যেনো ঝাপসা আলোয় ভেসে উঠলো - আচ্ছা মুন্নি কি আমার জন্য কষ্ট পাবে! ও কি ভাববে! আমি ওকে এভাবে একা ছেড়ে চলে গেলে ওর তো কষ্ট হবে!
হুট করেই চোখ দুটো খুলে মু্ন্নিকে ফোন দিলো তিথী!
ওপাশ থেকে মুন্নির গলাটায় ভেসে আসছে - কি হইছে তোর?
আঙ্কেল আন্টি বাসায় নাই?
খুবই কাতর কন্ঠে তিথী বললো - দোস্ত, আমি বাঁচতে চাই!
তারপর আর কিছু মনে নেই তিথীর
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো হাসপাতালের বিছানায়! পাশে বসে আছে মুন্নি! জ্বর তখনও তার শরীরে আছে তবুও একবার নিজের বন্ধুর জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসতে সে দ্বিধা করেনি। করিডোরে দাড়িয়ে তিথীর মা, যেনো নিজের ব্যস্ততায় সন্তানের এই অবস্থা তাকে নিজের কাছে অপরাধী বানিয়ে ফেলেছে, ঠিক তার পাশেই তার বাবা দাড়িয়ে নিজের অপরাধী হওয়ার উপলব্ধিতে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে!
তিথী উপলব্ধি করলোো, এ যেনো শেষ একটা আঁটকে থাকা শিকড়ে বন্যকবলিত উদ্ভিদের জীবনপণ টিকে থাকার লড়াই, এ যেনো শেষ একটা হাসিমুখের জন্য নিজের জন্য বাঁচার লড়াই!
আপ্রাণ চেষ্টা করে, নিজেকে সে যাত্রায় উপরওয়ালার কৃপায় যেনো বাঁচিয়ে ফেললো তিথী! এ যেনো তার এক পুনর্জন্ম। এতো কাছ থেকে মৃত্যুর স্বাদ পেয়ে ফিরে আসা যেনো এক আজন্ম সৌভাগ্য! জীবনটা কতোটা মূল্যবান তা বোধ হয় আজ তার চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না!
সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরার কিছুদিন পর, ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে মুন্নির সাথে দেখা হতেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিথী!
—–আমার জীবনটা বাঁচানোর জন্য উপরওয়ালা তোকে পাঠিয়েছিলো, তোর কাছে আজীবন ঋণী![ তিথী]
—–ধুর পাগল বন্ধুত্বে এসব বলতে হয় না! [মুন্নি]
দুজনেরই চোখই অশ্রুসিক্ত হয়ে জলজল করতে লাগলো! আর মুখে তৃপ্তির এক হাসি!
এরপর থেকে তিথী নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এখন সে হাসে, সবার সাথে মিশতে শিখে গেছে! মা বাবার সাথেও তার একটা দারুণ সম্পর্কে তৈরি হয়েছে!
একবার ক্লাসে ম্যাম হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো সবার জীবনের কিছু ইচ্ছা তোমরা এখানে লিখতে পারো!
- তিথী লিখলো সে একজন ভালো মা হতে চায়! সে পরিবারকে সময় দিতে চায়! আর মুন্নির মতো ভালো বন্ধুকে সবসময় পাশে পেতে চায়!
তার প্রাণোচ্ছল চেহারা যেনো বলছিলো, আমি জীবনকে আর একবার পেয়েছি! এবার আমি সুন্দর করে বাঁচতে চাই!
Author details:
Name: আসমাউল হুসনা তৃপ্তি
Email: asmaultripty08@gmail.com
Grade: Rajshahi University of Engineering and Technology Department: EEE Year: 2nd